মক্কা-মদিনা সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী
মক্কা-মদিনা সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী
সৌদি আরবের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গোটা বিশ্বেই আলোচনা চলছে। কেউ কেউ একে ভালোভাবে দেখছে, আবার কেউ বিষয়টা নিয়ে সমালোচনা করছে।
অনেকে এ প্রসঙ্গে কোনো কোনো হাদিসও টেনে আনতে চাইছেন। আসলে কিয়ামতের আগে মক্কা-মদিনা বা বর্তমান সৌদি আরবের পরিস্থিতি নিয়ে হাদিসে কী আছে, এখানে আমরা তা-ই খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছি।
ইমান মদিনার দিকে ফিরে আসবে : হজরত আবু হুরাইরা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই (কিয়ামতের পূর্বক্ষণে) ইমান মদিনা মুনাওয়ারার দিকে এমনভাবে প্রত্যাবর্তন করবে, যেমন সাপ তার গর্তের দিকে ফিরে আসে। ’ (বুখারি : হাদিস ১৮৭৬)
মুসলিমরা মদিনায় একত্র হবে
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, (কিয়ামতের আগে) মদিনার বসতি বিস্তৃত হয়ে ‘ইহাব’ অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। বর্ণনাকারী জুহাইর বলেন, আমি আমার শিক্ষক সুহাইলকে জিজ্ঞেস করলাম, তখন মদিনা কী পরিমাণ বিস্তৃত হবে? তিনি বললেন, ‘অনেক মাইল বিস্তৃত হবে। ’ (সহিহ মুসলিম : হাদিস ২৯০৩)
হজরত ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘শিগগিরই মুসলিমরা (কাফেরদের ভয়ে) মদিনার দিকে এমনভাবে বেষ্টিত হয়ে যাবে যে তাদের সবচেয়ে দূরের সীমানা হবে (খায়বারের নিকটবর্তী এলাকা) সালাহ নামক জায়গা। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪২৫০)
দাজ্জাল মক্কা-মদিনায় ঢুকতে পারবে না
হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘এমন কোনো শহর নেই, যেখানে দাজ্জাল প্রবেশ করবে না, তবে মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারা ছাড়া। কেননা মক্কা ও মদিনার প্রতিটি প্রবেশপথে ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে পাহারারত থাকবেন। তারপর মদিনা শরিফ তিনবার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠবে।
এতে সেখান থেকে সব কাফের ও মুনাফিক বের হয়ে যাবে। ’ (বুখারি, হাদিস : ১৮৮১)। হজরত আবু বাকরা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মদিনা মুনাওয়ারায় মাসিহ দাজ্জালের প্রভাব পড়বে না, তখন তার সাতটি প্রবেশপথ থাকবে, প্রত্যেক প্রবেশপথে দুজন করে ফেরেশতা পাহারারত থাকবেন। ’ (বুখারি, হাদিস ১৮৭৯)। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের দাজ্জাল সম্পর্কে দীর্ঘ বর্ণনা দেন। তাতে এ কথাও বলেন যে মদিনার প্রবেশপথে দাজ্জালের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকবে। সেদিন একজন মানুষ যে শ্রেষ্ঠ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হবে, সে দাজ্জালের কাছে গিয়ে বলবে যে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমি ওই দাজ্জাল, যার ব্যাপারে আমাদের রাসুলুল্লাহ (সা.) সাবধান করেছেন। দাজ্জাল তার সঙ্গীদের বলবে, আমি যদি তাকে হত্যা করে আবার জীবিত করতে পারি, তবে কি তোমরা আমার প্রভুত্বে সন্দেহ করবে? তারা বলবে, না। তখন সে ওই ব্যক্তিকে হত্যা করে আবার জীবিত করবে। ওই ব্যক্তি বলবে, আল্লাহর কসম! আমি এখন আরো নিশ্চিত হলাম যে তুমি দাজ্জাল। তখন দাজ্জাল বলবে, তাকে আমি হত্যা করব। কিন্তু সে আর তাকে হত্যা করতে সক্ষম হবে না। ’ (বুখারি, হাদিস : ১৮৮২)
হেজাজ থেকে আগুন বের হবে
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ হেজাজের জমিন থেকে এমন ভয়াবহ আগুনের আবির্ভাব হবে না, যার ফলে বুসরার উটের গর্দানও আলোকিত হয়ে যাবে। ’ (বুখারি : হাদিস : ৭১১৮)
মক্কার দিকে অগ্রসরমাণ শত্রুবাহিনী ভূমিধসে পতিত হবে
হজরত উম্মে সালামা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘জনৈক আশ্রয় গ্রহণকারী বাইতুল্লাহ শরিফে আশ্রয় গ্রহণ করবে। তখন তাকে পাকড়াও করার জন্য সৈন্য পাঠানো হবে। কিন্তু ওই দল যখন বাইদা নামক স্থানে এসে পৌঁছবে, তখন ভূমিধসে সবাই তলিয়ে যাবে। উম্মে সালামা (রা.) বলেন, আমি আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! তাদের মধ্যে যদি কেউ এমন হয় যে সে এই দলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেনি; বরং তাদের জোরপূর্বক নেওয়া হয়েছে, তাদেরও কি এ শাস্তি দেওয়া হবে? তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, হ্যাঁ, সবাই ভূমিধসে পতিত হবে, যদিও কিয়ামতের দিন যার যার নিয়তের ওপর ফায়সালা করা হবে। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৮৮২)
কিয়ামতের আগে কাবা শরিফ ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘(কিয়ামতের পূর্বে) কাবা শরিফকে হাবশার (বর্তমানে আবিসিনিয়া) জনৈক ব্যক্তি ধ্বংস করবে, যার পা চিকন হবে। (বুখারি, হাদিস : ১৫৯১)
আবু দাউদ ও অন্যান্য হাদিসের কিতাবের বর্ণনায় রয়েছে যে ওই ব্যক্তি কাবা শরিফের গুপ্তধন আত্মসাৎ করার জন্য কাবা শরিফ ধ্বংস করবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৩০৯)
মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় রয়েছে, ওই ব্যক্তি কাবা শরিফের গিলাফ ও অন্যান্য সম্পদ কেড়ে নেবে। যেন আমি দেখছি, জনৈক টাকমাথা ও বাঁকা পাবিশিষ্ট ব্যক্তি কোদাল ও কুঠার দিয়ে কাবা ঘরে আঘাত করছে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৭০৫৩)
হজরত সাউবান (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের গুপ্তধন নিয়ে তিন ব্যক্তি যুদ্ধ করবে, যারা সবাই খলিফার সন্তান, কিন্তু ওই ধন তারা একজনও পাবে না। অতঃপর পূর্বদেশ থেকে কালো পতাকাবাহীরা বের হবে, যারা তোমাদের এমনভাবে হত্যা করবে, যা এর আগে কেউ করেনি। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো কিছু কথা বলেন, যা আমার এখন স্মরণে নেই। অতঃপর বললেন, যখন তোমরা তাকে দেখবে, তার হাতে বাইআত গ্রহণ করবে, বরফের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে এসে হলেও, কেননা তিনি হলেন আল্লাহর খলিফা মাহদি। ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০৮৪)
এ হাদিসে গুপ্তধনের ব্যাখ্যায় আল্লামা সিন্দি (রহ.) বলেন, এর দ্বারা আরবের রাজত্ব বোঝানো হয়েছে। ইমাম ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, এখানে বাহ্যত গুপ্তধন দ্বারা কাবা শরিফের গুপ্তধনই উদ্দেশ্য হওয়া বোঝা যায়। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বোঝা যায় যে কিয়ামতের আগে ওই কালো পতাকাবাহীরা ইমাম মাহদির সঙ্গে যুক্ত হবেন এবং মাহদির দলভুক্ত হবেন। (হাশিয়াতুস সিন্দি আলা ইবনে মাজাহ : ২/৫১৮)
কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে যুগে যুগে সে-ই আব্বাসী খেলাফতের শুরুলগ্ন থেকে অনেকেই নিজেদের ওই দল বোঝানোর জন্য কালোপতাকা নিয়ে অভিযানে নেমেছে। কেউ বা নিজেকে মাহদিও দাবি করে বসেছে, এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। বরং ওই দলের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। ইমাম মাহদির ব্যাপারে অনেক হাদিসেই বিভিন্ন আলামত ও অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, যেমন তিনি নিজেকে গোপন রাখবেন, তবে নেককাররা তাঁকে চিনে ফেলবেন। তিনি হজরত হাসান (রা.)-এর বংশের হবেন, তাঁর নাম মুহাম্মদ হবে, তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ হবে ইত্যাদি। তাই যুগে যুগে যারা নিজেকে মাহদি পরিচয় দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে বিভিন্ন অভিযানে লিপ্ত হয়েছে, তারা ভ্রষ্টতা ও ভ্রান্তির শিকার হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায়, অনেকে উল্লিখিত হাদিসকে সৌদি আরবের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করতে চায়। এর সঙ্গে সৌদি আরবের বর্তমান পরিস্থিতির কোনো সম্পর্ক নেই।